বিষয়ঃ “যার অন্তরে জাররা পরিমাণ ঈমান আছে, সেও একদিন ‘দোযখের’ শাস্তি ভোগের পর ‘বেহেশতে’ প্রবেশ করবে” – আসলেই কি তাই?
─━═●═━─ ─━═●═━─ ─━═●═━─
মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ তা’য়ালা বিচার দিবসের মালিক – মালিকি ইয়াওমিদ্দীন। তাঁর কহ্হার সত্তার পূর্ণ প্রকাশ সেদিন মানব জাতি প্রত্যক্ষ করবে। যমীন সেদিন তাঁর নূরে উদ্ভাসিত হবে। শাফায়াত বা তদবির সংক্রান্ত পূর্ণ এখতিয়ারও সেদিন তিনিই সংরক্ষণ করবেন। আল্লাহ তা’য়ালার অনুমতি পেলে কুরআন নির্ধারিত কতিপয় শর্তসাপেক্ষে নবী-রাসূলগণসহ অনেকে সুপারিশের অনুমোদন পাবেন। তবে শাফায়াত সংক্রান্ত বিস্তৃত আলোচনা বক্ষ্যমান নিবন্ধের উপজীব্য নয়।
আমরা প্রথমেই জানতে চাইব যে, কুরআনে এমন কোন আয়াত আছে কিনা যেখানে ঠিক এভাবেই বলা হয়েছে যে, অনু পরিমান ঈমানের অধিকারী একদল বান্দা তাদের পাপের কারণে জাহান্নামের নির্দিষ্ট শাস্তি ভোগের পর শেষনবীর সুপারিশ সাপেক্ষে জান্নাত লাভ করবে।
না, তেমন কোন কথাই কুরআন মাজীদে বলা হয় নি। বা এমনও কোন আয়াত নেই, যেখানে এই ইঙ্গিত আছে যে, অন্তরে সামান্য ঈমান অবশিষ্ট থাকার কারণে জাহান্নাম থেকে কেউ মুক্তি পেয়ে ফিরে আসবে। তাহলে কুরআনে কী আছে সেটাই আমরা জানতে চেষ্টা করি।
কারা জাহান্নামের বাসিন্দা আর কারা জান্নাতের বাসিন্দা তা কুরআনে বারবার বলা হয়েছে। এই বক্তব্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো এসব আয়াতের প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে শেষে বলে দেয়া হয়েছে – “হুম ফীহা খলীদুন”, আর একটি হলো “খলিদীনা ফীহা আবাদা”; মানে তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বা চিরকালের জন্য প্রবেশ করবে। এটা জান্নাতীদের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়েছে; আবার জাহান্নামের বাসিন্দাদের জন্যও সমভাবে ও একই বাক্যবিণ্যাসে বলা হয়েছে।
দাখিল হওয়া মানে প্রবেশ করা, তবে তা অস্থায়ী প্রবেশ – মানে কোথাও প্রবেশের পর যেখান থেকে আবার বের হতে হয়। অন্যদিকে আল-খলদুন ক্রিয়ামূল-এর অর্থ পুরো কুরআন জুড়েই চিরস্থায়ী (forever) প্রবেশ – মানে যেখানে অনুপ্রবেশ করা যায়; কিন্তু বের হওয়া যায় না।
ইংরেজি অনুবাদকগণ খলদুন-এর অর্থ করতে কোন সংশয়ের আশ্রয় নেন নি; তারা সর্বত্র forever-ই লিখেছেন। কিন্তু বাংলা ভাষায় কতিপয় অনুবাদক এব ব্যত্যয় করেছেন – তারা লিখেছেন ‘দীর্ঘকাল’। এই কাজটি তারা কেন করেছেন, সেটা তারা এবং আল্লাহ তা’য়ালা ভালো জানেন। অন্যদিকে “আবাদান (أَبَدًا)” অর্থও চিরকাল বা অনন্তকাল। পাশাপাশি তাগিদ প্রদান করে চিরস্থায়িত্বের শাস্তি ঘোষণার পরও তারা চিরকাল বা চিরস্থায়ী না লিখে কীভাবে ‘দীর্ঘকাল’ লিখতে পারেন তা ভাববার বিষয়। তবে কোন সন্দেহ নেই, চিরস্থায়ীর পরিবর্তে এই ‘দীর্ঘকাল’ লেখার দ্বারা “জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ তত্ত্ব” অনেকেটাই বৈধতা পেয়েছে। যেমন. জহুরুল হক ‘খলীদিনা ফীহা আবাদান’-এর অর্থ লিখেছেন –
শুধু আল্লাহ্ থেকে পৌঁছে দেওয়া, আর তাঁর বাণীসমূহ। আর যে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের অবাধ্যতা করে, তার জন্য তবে নিশ্চয়ই রয়েছে জাহান্নামের আগুন, তাতে তারা থাকবে দীর্ঘকাল। -৭২:২৩
যাতে তারা থাকবে সুদীর্ঘকাল, তারা পাবে না কোনো অভিভাবক, আর না কোনো সহায়ক। -৩৩:৬৫
শুধু জাহান্নামের পথে ছাড়া, তারা সেখানে থাকবে সুদীর্ঘকাল। আর আল্লাহ্র পক্ষে এটা হচ্ছে সহজ। -৪:১৬৯
وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
কিন্তু যারা অবিশ্বাস পোষণ করে ও আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে, তারাই হচ্ছে আগুনের বাসিন্দা, তারা তার মধ্যে থাকবে দীর্ঘকাল। -২:৩৯
অথচ একই অনুবাদক জান্নাতিদের ক্ষেত্রে ‘চিরকাল’, ‘অনন্তকাল’ ব্যবহার করেছেন।
وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا
আর যারা ঈমান আনে ও সৎকাজে করে তাদের আমরা শীঘ্রই প্রবেশ করাবো স্বর্গোউদ্যানসমূহে, যাদের নিচে দিয়ে বয়ে চলে ঝরনারাজি, তাতে তারা থাকবে চিরকাল। -৪:৫৭
وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا وَعْدَ اللَّهِ حَقًّا وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ قِيلًا
যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকর্ম করেছে, আমি তাদেরকে উদ্যানসমূহে প্রবিষ্ট করাব, যেগুলোর তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হয়। তারা চিরকাল তথায় অবস্থান করবে। আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সত্য সত্য। আল্লাহর চাইতে অধিক সত্যবাদী কে? -৪:১২২
لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ وَقَالَ الْمَسِيحُ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اعْبُدُوا اللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ
তারা কাফের, যারা বলে যে, মরিময়-তনয় মসীহ-ই আল্লাহ; অথচ মসীহ বলেন, হে বণী-ইসরাঈল, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর, যিনি আমার পালন কর্তা এবং তোমাদেরও পালনকর্তা। নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন। এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই। -৫:৭২
إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِينَ
নিশ্চয়ই যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে এবং এগুলো থেকে অহংকার করেছে, তাদের জন্যে আকাশের দ্বার উম্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। যে পর্যন্ত না সূচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে। আমি এমনিভাবে পাপীদেরকে শাস্তি প্রদান করি। -৭:৪০
কুরআন মোটাদাগে কিয়ামতবাসীদের তিনভাগে বিভক্ত করে-
وَكُنْتُمْ أَزْوَاجًا ثَلَاثَةً * فَأَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ مَا أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ * وَأَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ مَا أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ * وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ * أُولَئِكَ الْمُقَرَّبُونَ
এবং তোমরা তিনভাবে বিভক্ত হয়ে পড়বে। যারা ডান দিকে, কত ভাগ্যবান তারা। এবং যারা বামদিকে, কত হতভাগা তারা। অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তীই। তারাই নৈকট্যশীল। -৫৬:৭-১১
এই তিন ভাগের মধ্যেই আবার কতগুলো শ্রেণী রয়েছে - তাদের শেষ গন্তব্য কোথায়, তার একটা সংক্ষিপ্ত শ্রেণি বিভাগ দাঁড় করাতে চেষ্টা করি।
এক. আছহাবুল জান্নাহ - মুসলিম
─━═●═━─
মুমিন-মুসলিমগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের মধ্যে মর্যাদাগত তারতম্য আছে – আগে পিছের বিষয়ও আছে। আবার একদলকে বলা হয়েছে সাবিকুন বা অগ্রবর্তী। যাই হোক, তারা কারা সে সম্পর্কিত কুরআনী বর্ণনা বহু বর্ণিল ও ব্যাপক। আমরা কতিপয় আয়াত পেশ করব মাত্র।
لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ وَلَا يَرْهَقُ وُجُوهَهُمْ قَتَرٌ وَلَا ذِلَّةٌ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
যারা সৎকর্ম করেছে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ এবং তারও চেয়ে বেশী। আর তাদের মুখমন্ডলকে আবৃত করবে না মলিনতা কিংবা অপমান। তারাই হল জান্নাতবাসী, এতেই তারা বসবাস করতে থাকবে অনন্তকাল। -১০:২৬
وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তারাই জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে। -২:৮২
إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَخْبَتُوا إِلَى رَبِّهِمْ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে এবং স্বীয় রব্বের সমীপে মিনতি প্রকাশ করেছে তারাই জান্নাতবাসী, সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে। -১১:২৩
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ * أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের রব্ব আল্লাহ অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না। তারাই জান্নাতের অধিকারী! তারা তথায় চিরকাল থাকবে। তারা যে কর্ম করত, এটা তারই প্রতিফল। -৪৬:১৩-১৪
শুধু তাই নয়, পৃথিবী থেকে বিদায়ের প্রাক্কালেই তারা জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে যায়।
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ
নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের রব্ব আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ শোন। -৪১:৩০
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ * أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের রব্ব আল্লাহ অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না। তারাই জান্নাতের অধিকারী! তারা তথায় চিরকাল থাকবে। তারা যে কর্ম করত, এটা তারই প্রতিফল।
-৪৬:১৩-১৪
এটাও নিশ্চিত করা হয়েছে যে, জান্নাতে তারা স্থায়ীভাবে বা চিরদিনের জন্য প্রবেশ করবে - জালিকা ইয়াওমূল খূলুদ (ইহাই চিরস্থায়ী প্রবেশের দিন)।
مَنْ خَشِيَ الرَّحْمَنَ بِالْغَيْبِ وَجَاءَ بِقَلْبٍ مُنِيبٍ * ادْخُلُوهَا بِسَلَامٍ ذَلِكَ يَوْمُ الْخُلُودِ
যে না দেখে দয়াময় আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করত এবং বিনীত অন্তরে উপস্থিত হত। তোমরা এতে শান্তিতে প্রবেশ কর। এটাই অনন্তকাল বসবাসের জন্য প্রবেশ করার দিন। -৫০:৩৩-৩৪
দুই. আছহাবুল জাহীম বা আছহাবুন নার - কাফের চিরস্থায়ী জাহান্নামী
─━═●═━─
যারা কুরআনের সত্যে বিশ্বাসী নয় বা প্রত্যাখ্যানকারী, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ী হবে। যেমন-
وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ
যারা অবিশ্বাস করে এবং আমাদের নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে, তার জাহান্নামের বাসিন্দা। -৫:১০, ৫:৮৬, ৫৭:১৯
وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
কিন্তু যারা অবিশ্বাস পোষণ করে ও আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে, তারাই হচ্ছে আগুনের বাসিন্দা, তারা তার মধ্যে থাকবে অনন্তকাল। -২:৩৯, ৬৪:১০
وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا
যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে, তার জন্যে রয়েছে জাহান্নামের অগ্নি। তথায় তারা চিরকাল থাকবে। -৭২:২৩
إِنَّ اللَّهَ لَعَنَ الْكَافِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمْ سَعِيرًا * خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا لَا يَجِدُونَ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا
আল্লাহ্ নিশ্চয়ই অবিশ্বাসী কাফেরদের ধিক্কার দিয়েছেন আর তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন এক জ্বলন্ত আগুন - যাতে তারা থাকবে অনন্তকাল, তারা পাবে না কোনো অভিভাবক, আর না কোনো সহায়ক।-৩৩:৬৪-৬৫
তিন. মুরতাদের জন্য চিরস্থায়ী জাহান্নাম
─━═●═━─
যারা দীন ইসলামের মধ্যে ছিল, কিন্তু দীন পরিত্যাগ করেছে বা ইসলাম থেকে ফিরে গেছে; মানে মুরতাদ হয়েছে – তাদের চূড়ান্ত ও স্থায়ী গন্তব্যও জাহান্নাম।
وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
আর তোমাদের মধ্যে থেকে যে তার ধর্ম থেকে ফিরে যায় (মুরতাদ হয়) ও মারা যায় অবিশ্বাসী থাকা অবস্থায়, তা হলে এরাই- এদের সব কাজ এই দুনিয়াতে ও আখেরাতে বৃথা যাবে। আর তারাই হচ্ছে আগুনের অধিবাসী, তারা এতে থাকবে চিরকাল। -২:২১৭
إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَى لَهُمْ * فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ
নিশ্চয় যারা সোজা পথ ব্যক্ত হওয়ার পর তৎপ্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে ফিরে যায় (মুরতাদ হয়), শয়তান তাদের জন্যে তাদের কাজকে সুন্দর করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দেয়। ………….. ফেরেশতা যখন তাদের মুখমন্ডল ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে, তখন তাদের অবস্থা কেমন হবে? -৪৭:২৫-২৭
আমাদের আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে যারা চিরস্থায়ী জান্নাতে যাবেন সেইসব মুমিন-মুসলিম এবং যারা চিরস্থায়ী জাহান্নামে যাবে সেইসব মুজরিম কাফিরকে প্রথমেই আলাদা করে রাখি। এর মধ্যে একশ্রেণির সত্য প্রত্যাখ্যানকারী আছে, যাদের জন্য কিয়ামতে কোন ‘ওজন স্থাপন করা হবে না’ মর্মে ঘোষণা আছে - অর্থাৎ যারা বিনা হিসেবে জাহান্নামে যাবে।
এর মধ্যে এক শ্রেণি আছে যাদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন ওজন বা পাল্লাই স্থাপন করা হবে না। সূরা কাহাফের ১০২ নম্বর আয়াতে কাফেরদের একদলের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যারা মনে করে পৃথিবীতে তারা খুব ভাল কাজ করছে, অথচ তারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ।
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا * الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا * أُولَئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآَيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا
বলো, আমি কি তোমাদেরকে সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিবজীবনে বিভ্রান্ত হয়, অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করেছে। তারাই সে লোক, যারা তাদের পালনকর্তার নিদর্শনাবলী এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতের বিষয় অস্বীকার করে। ফলে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। সুতরাং কেয়ামতের দিন তাদের জন্য আমি কোন ওজনই স্থাপন করব না। -১৮:১০৩-১০৫
চার. কিয়ামতের ময়দানের এক বিশেষ শ্রেণি - অপেক্ষমান আ’রাফবাসী
─━═●═━─
বিশুদ্ধ চিত্ত মুমিনগণ জান্নাতে যাবে, কাফির-মুরতাদ, মুনাফিক-মুশরিক, ফাসিক জাহান্নামে যাবে। তবে একশ্রেণির বিশ্বাসী বান্দাগণ যারা এই দুই অবস্থানের মধ্যে অপেক্ষমান থাকবে। সূরা আ’রাফে বিস্তৃতভাবে তাদের অবস্থার কথা বর্ণনা করা হয়েছে – বিবৃতি এতটাই সুস্পষ্ট যে, তা বোঝার জন্য অতিরিক্ত কোন বাক্যব্যয় করতে হয় না। তাই আমরা সরাসরি আয়াতগুলোতে চলে যাই।
وَنَادَى أَصْحَابُ الْجَنَّةِ أَصْحَابَ النَّارِ أَنْ قَدْ وَجَدْنَا مَا وَعَدَنَا رَبُّنَا حَقًّا فَهَلْ وَجَدْتُمْ مَا وَعَدَ رَبُّكُمْ حَقًّا قَالُوا نَعَمْ فَأَذَّنَ مُؤَذِّنٌ بَيْنَهُمْ أَنْ لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ * الَّذِينَ يَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا وَهُمْ بِالْآَخِرَةِ كَافِرُونَ * وَبَيْنَهُمَا حِجَابٌ وَعَلَى الْأَعْرَافِ رِجَالٌ يَعْرِفُونَ كُلًّا بِسِيمَاهُمْ وَنَادَوْا أَصْحَابَ الْجَنَّةِ أَنْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَمْ يَدْخُلُوهَا وَهُمْ يَطْمَعُونَ * وَإِذَا صُرِفَتْ أَبْصَارُهُمْ تِلْقَاءَ أَصْحَابِ النَّارِ قَالُوا رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ * وَنَادَى أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَى عَنْكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ * أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ * وَنَادَى أَصْحَابُ النَّارِ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ أَنْ أَفِيضُوا عَلَيْنَا مِنَ الْمَاءِ أَوْ مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَهُمَا عَلَى الْكَافِرِينَ
জান্নাতীরা জাহান্নামীদেরকে ডেকে বলবেঃ আমাদের সাথে আমাদের রব্ব যে ওয়াদা করেছিলেন, তা আমরা সত্য পেয়েছি? অতএব, তোমরাও কি তোমাদের রব্বের ওয়াদা সত্য পেয়েছ? তারা বলবেঃ হ্যাঁ। অতঃপর একজন ঘোষক উভয়ের মাঝখানে ঘোষণা করবেঃ আল্লাহর অভিসম্পাত জালেমদের উপর। যারা আল্লাহর পথে বাধা দিত এবং তাতে বক্রতা অন্বেষণ করত। তারা পরকালের বিষয়েও অবিশ্বাসী ছিল। উভয়ের মাঝখানে একটি প্রাচীর থাকবে এবং আ’রাফের উপরে অনেক লোক থাকবে। তারা প্রত্যেককে তার চিহ্ন দ্বারা চিনে নেবে। তারা জান্নাতীদেরকে ডেকে বলবেঃ সালামুন আলাইকুম (তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক)। তারা তখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না, কিন্তু প্রবেশ করার ব্যাপারে আগ্রহী হবে। যখন তাদের দৃষ্টি জাহান্নামীদের উপর পড়বে, তখন বলবেঃ হে আমাদের রব্ব, আমাদেরকে এ জালেমদের সাথী করো না। আ’রাফবাসীরা যাদেরকে তাদের চিহ্ন দ্বারা চিনবে, তাদেরকে ডেকে বলবে তোমাদের দলবল ও ঔদ্ধত্য তোমাদের কোন কাজে আসেনি। এরা কি তারাই; যাদের সম্পর্কে তোমরা কসম খেয়ে বলতে যে, আল্লাহ এদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন না। (অথচ তাদের প্রতি অনুগ্রহ করে বলা হয়েছে যে,) প্রবেশ কর জান্নাতে, তোমাদের কোন আশঙ্কা নেই এবং তোমরা দুঃখিত হবে না। জাহান্নামীরা জান্নাতীদেরকে ডেকে বলবেঃ আমাদের উপর সামান্য পানি নিক্ষেপ কর অথবা আল্লাহ তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছেন, তা থেকেই কিছু দাও। তারা বলবেঃ আল্লাহ এই উভয় বস্তু কাফেরদের জন্যে হারাম করেছেন, তারা স্বীয় ধর্মকে তামাশা ও খেলা বানিয়ে নিয়েছিল এবং পার্থিব জীবন তাদেরকে ধোকায় ফেলে রেখেছিল। অতএব, আমি আজকে তাদেরকে ভুলে যাব; যেমন তারা এ দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল এবং যেমন তারা আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করত। -৭:৪৪-৫০
এখন আমরা আরও তিনটি শ্রেণী নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করব যারা জাহান্নামী, যাদের বিষয়ে পরবর্তী পর্বে আরও বিস্তারিত আলোচনা থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
পাঁচ. মুশরিক – চিরস্থায়ী জাহান্নামী
─━═●═━─
যে ব্যক্তি আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা বা অধিকারের ক্ষেত্রে কাউকে কোনোরূপ অংশী সাব্যস্ত করে, সে মুশরিক। সোজা কথায় যে স্রষ্টার সাথে অংশীদার স্থাপন করে বা শিরক করে সে মুশরিক। কী কী কাজ বা কথার দ্বারা আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন হয়, সে আলোচনায় আমরা এখানে যাব না। তবে আল্লাহর বিবেচনায় এটি সবচেয়ে সাংঘাতিক অপরাধ যা তিনি ক্ষমা করতেই রাজী নন। এতদ্ভিন্ন বহু অপরাধ মার্জনা করে দেবার বিষয়ে তাঁর ওয়াদা আছে।
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে শরিক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। আর যে লোক আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করল, সে যেন কঠিন অপবাদ আরোপ করল। -৪:৪৮, ৪:১১৬
শুধু তাই নয়, খাতামুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ কোনভাবে আল্লাহর সাথে শিরক করলে তাঁর সকল আমল বরবাদ হয়ে যেত বলে হুমকি আছে কুরআনে। অর্থাৎ রেসালাতের দায়িত্ব পূর্ণরূপে পালন, নবীর সারাজীবনের সকল আমলে ছালেহ ইত্যাদি একটি মাত্র অপরাধের কারণে পন্ড হয়ে যেত। কী ভয়াবহ কথা- যে ব্যাপারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে আল্লাহ কোন দ্বিধা করেন নাই।
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
আর তোমার কাছে ও তোমার আগে যারা ছিল তাঁদের কাছে নিশ্চয়ই ইতিপূর্বে প্রত্যাদিষ্ট হয়েছে- যদি তুমি আল্লাহর শরিক স্থির তাহলে তোমার কাজকর্ম নিশ্চয়ই নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। -৩৯:৬৫
সম্পূর্ণ একই বক্তব্য ১৮ জন নবীর নাম উল্লেখ করে সূরা আন’আমের ৮৩-৯০ আয়াতে বলা হয়েছে। যেহেতু মুশরিকরা কখনও আল্লাহর ক্ষমা পাবে না, তাই তাদর ব্যাপারে ক্ষমা প্রার্থনা করাও নিষেধ।
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ
নবী ও মুমিনদের উচিত নয় মুশরেকদের মাগফেরাত কামনা করে, যদিও তারা আত্নীয় হোক একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামী। -৯:১১৩
এখন এই মুশরিকদের একটা বড় অংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেই বিদ্যমান। যেমন সূরা ইউসুফে বলা হয়েছে -
وَمَا أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِينَ
(নবীকে) তুমি যতই চাও না কেন, অধিকাংশ লোক মুমিন হবে না। -১২:১০৩
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ
অনেক মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে। -১২:১০৬
তাহলে যে অতি অল্প সংখ্যক মানুষ ঈমান আনে তাদের মধ্যে অধিকাংশ (আকছার) শিরক না করে ছাড়ে না। যার মানে, নামে মুললিম কিন্তু প্রকৃত বিচারে মুশরিক এমন সকলেই স্থায়ীভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
ছয়. মুনাফিকের জন্য সর্ব নিকৃষ্ট জাহান্নাম
─━═●═━─
আবার যারা মুসলিম পরিচয়ে বাহ্যিক জীবন-যাপন করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুনাফিক, তারা কাফেরদের চেয়েও নিকৃষ্ট জাহান্নামের বাসিন্দা হবে। আর এই সম্প্রদায়ের জন্য জাহান্নামের অবস্থিতি চিরকালের জন্য। একজন মুনাফিক অপরিহার্যভাবে একইসাথে একজন কাফের বা মুশরিকও।
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ تَوَلَّوْا قَوْمًا غَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مَا هُمْ مِنْكُمْ وَلَا مِنْهُمْ وَيَحْلِفُونَ عَلَى الْكَذِبِ وَهُمْ يَعْلَمُونَ * أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا إِنَّهُمْ سَاءَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ * اتَّخَذُوا أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ فَلَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ * لَنْ تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করো নি, যারা আল্লাহর গযবে নিপতিত সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব করে? তারা মুসলমানদের দলভুক্ত নয় এবং তাদেরও দলভূক্ত নয়। তারা জেনেশুনে মিথ্যা বিষয়ে শপথ করে। আল্লাহ তাদের জন্যে কঠোর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। নিশ্চয় তারা যা করে, খুবই মন্দ। তারা তাদের শপথকে ঢাল করে রেখেছেন, অতঃপর তারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বাধা প্রদান করে। অতএব, তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি। আল্লাহর কবল থেকে তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদেরকে মোটেই বাঁচাতে পারবেনা। তারাই জাহান্নামের অধিবাসী তথায় তারা চিরকাল থাকবে। -৫৮:১৭
وَعَدَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا هِيَ حَسْبُهُمْ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُقِيمٌ
ওয়াদা করেছেন আল্লাহ, মুনাফেক পুরুষ ও মুনাফেক নারীদের এবং কাফেরদের জন্যে জাহান্নামের আগুনের - তাতে পড়ে থাকবে সর্বদা। সেটাই তাদের জন্যে যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্যে রয়েছে স্থায়ী আযাব। -৯:৬৮
এখানে ‘আযাবুম মুকীম’ মানে যে শাস্তির কোন শেষ নেই (never ending punishment / lasting torment)। কুরআনে একাধিকবার চিরস্থায়ী শাস্তি” অর্থেই ‘আযাবুম মুকীম’ ব্যবহৃত হয়েছে। আবার “নায়িমুম মুকীম (نَعِيمٌ مُقِيمٌ)”-এর বিপরীত ধারণাও বিদ্যমান আছে (৯:২১)।
সাত. ফাসিক সম্প্রদায়
─━═●═━─
কাফির, মুনাফিক, মুশরিক ও ফাসিকের মধ্যে মৌলিক ও গুণগত পার্থক্য কী কী?
কাফিরঃ কাফির সম্প্রদায় শাশ্বত সত্যকে প্রত্যাখ্যানকারী রা অস্বীকারকারী।
মুশরিকঃ মুশরিক হলো, যে ব্যক্তি আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা বা অধিকারের ক্ষেত্রে কাউকে কোনোরূপ অংশী সাব্যস্ত করে। আল্লাহর বিধানকে একমাত্র মূল বিধান হিসেবে গ্রহণ না করে অন্য কারো বিধানকেও মূল বিধানের অংশী সাব্যস্ত করে।
প্রত্যেক কাফির মুশরিক নয়, কিন্তু প্রত্যেক মুশরিক একই সাথে কাফির।
মুনাফিকঃ মুনাফিক হলো যে ব্যক্তি কাফির বা মুশরিক কিন্তু সে নিজেকে মুমিন বলে দাবি করে বা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে মিশে থাকে।
ফাসিকঃ একজন ফাসিক অপরিহার্যভাবে একইসাথে কাফির, মুশরিক ও মুনাফিক।
কুরআনে ফাসিক শব্দটি ইবলিশ শয়তান, কাফির, মুশরিক, মুনাফিক্ব সবার জন্য সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ কাফিররাও ফাসিক, মুশরিকরাও ফাসিক, মুনাফিকরাও ফাসিক। যেমন, কুরআনে বলা হয়েছে -
أَفَمَنْ كَانَ مُؤْمِنًا كَمَنْ كَانَ فَاسِقًا لَا يَسْتَوُونَ
তাহলে কি যে মুমিন সে তার মতো যে ফাসিক (সত্যত্যাগী)? তারা সমতুল্য নয়। -৩২:১৮
ফাসিক গোষ্ঠীও বাহ্যত মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। মুনাফিকদের সাথে তাদের সাদৃ্শ্য রয়েছে। এরাও আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত হয়ে জাহান্নামের বাসিন্দা হবে।
سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَسْتَغْفَرْتَ لَهُمْ أَمْ لَمْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ لَنْ يَغْفِرَ اللَّهُ لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
তুমি তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো অথবা না করো, উভয়ই সমান। আল্লাহ কখনও তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না। -৬৩:৬
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ لِمَ تُؤْذُونَنِي وَقَدْ تَعْلَمُونَ أَنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
স্মরণ কর, যখন মূসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা কেন আমাকে কষ্ট দাও, অথচ তোমরা জান যে, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রসূল। অতঃপর তারা যখন বক্রতা অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ তাদের অন্তরকে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না। -৬১:৫
وَقَوْمَ نُوحٍ مِنْ قَبْلُ إِنَّهُمْ كَانُوا قَوْمًا فَاسِقِينَ
আমি ইতিপূর্বে নূহের সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছি। নিশ্চিতই তারা ছিল পাপাচারী সম্প্রদায়। -৫১:৪৬
শেষকথা
এই হচ্ছে কিয়ামতের ময়দানে কুরআন বর্ণিত সাধারণ চিত্র – যেখানে একদলের জন্য আসমানের দরজা খুলে দেয়া হবে এবং তারা জান্নাতে অবস্থান করবে। অন্যদলের জন্য আসমানের দরজা উন্মুক্ত করা হবে না – তারা নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামে।
আর একটি বড় দল আ’রাফের উপর অপেক্ষমান থাকবে জান্নাতে যাবার প্রতীক্ষায়। এই দলটি সম্ভবত তারা যারা তাদের আমলের ঘাটতি বা বিচারের মানদন্ডে আটকে গিয়ে একটা দীর্ঘ সময় কিয়ামতের মাঠে প্রতীক্ষারত থাকতে বাধ্য হবে।
কিন্তু পাপের কারণে প্রথমে জাহান্নামে যাবে, আবার পুড়ে কয়লা হয়ে ফের জান্নাতে প্রবেশ করবে – এটা শয়তানের কারখানায় তৈরি গল্প বৈ আর কিছু নয়।
⊙══════⊙══════⊙
-আবু সাঈদ খান